শিল্পীরা একে অন্যের শত্রু হয় এমনকথা মাঝে মধ্যেই শোনা যায়। তবে এহেন কথা যে নিছকই অবাস্তব সে প্রমাণও মাঝে মধ্যেই পাওয়া যায়। সেরকম না হলে আজ তবলাবাদক জাকির হোসেনের প্রয়াণে এমন শোকের ছায়া নামতো না সংগীত জগতে। শিল্পীর প্রয়াণে মনভার শিল্প জগতের অন্যান্য ক্ষেত্রের শিল্পীদেরও। জাকির হোসেনের মৃত্যু সংবাদ সত্যি বলে মানতেই পারছেন না সুরসম্রাট এ আর রহমান। মনকে শান্তনা জোগাচ্ছেন সুরের রাণী শ্রেয়া ঘোষালও।
জাকির হোসেনের মৃত্যুতে তাঁর উদ্দ্যেশ্যে শ্রদ্ধার্ঘ জ্ঞাপন করলেন উস্তাদ আমজাদ আলি খান। টুকিটাকি প্রচুর কথা তিনি জাকির হোসেনকে নিয়ে বললেন। তাঁর কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জাকির হোসেনের মৃত্যুতে কতটা ব্যথিত তিনি। সঙ্গে এও বোঝা যাচ্ছে জীবনকালে জাকির হোসেনের কতটা কাছের মানুষ ছিলেন আমজাদ আলী খান।
শারীরিকভাবে চলে গেলেও সারাজীবন উস্তাদের মনের মণিকোঠায় বেঁচে থাকবেন জাকির হোসেন—
শুরুতেই জাকির হোসেনকে ভাই বলে সম্বোধন করলেন আমজাদ আলী। বললেন জাকির হোসেনের চলে যাওয়ার খবর এক বিশাল ধাক্কা দিয়ে গেল তাঁর জীবনে। তিনি এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এত দ্রুত জাকির হোসেন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। জাকির হোসেন এমনিতে পাঞ্জাব ঘরানার বাদক ছিলেন। তবে কালক্রমে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য ঘরানা। তবলার যে বহুমুখী রূপ থাকতে পারে তা জাকির হোসেনের বাজনায় প্রমাণিত। উস্তাদ বলেন, শুধুমাত্র জাকির হোসেনের কারণেই বিশ্বে হয়তো হাজার পাঁচেক মানুষ আজ তবলা বাজান। এ কিন্তু কম বড় কথা নয়।
ঈশ্বরের বিশেষ আশীর্বাদপুত্র ছিলেন জাকির হোসেন। সঙ্গে পেয়েছিলেন নিজের বাবা উস্তাদ আল্লারাখা খান কুরেশির আশীর্বাদ। বাবা অথবা গুরু যাই বলা হোক, তাঁর আশীর্বাদেই জাকির হোসেনের বাজনা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। জাকির হোসেনের ব্যাপারে প্রতিটি কথা বলার সময় তাকে ভাই বলে সম্বোধন করেন আমজাদ আলী।
বাজনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হিসেবেও জাকির হোসেনের কোনো তুলনা ছিল না। শৈশব এবং যৌবন থেকেই তিনি নিজের থেকে বয়সে বড় এবং প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পীদের খুবই সম্মান করতেন। তাঁর সঙ্গে পণ্ডিত কিষেণ মহারাজ বা শামতাপ্রসাদরা যখন বাজাতেন, জাকির হোসেন নাকি সবসময় তাঁদের তবলার ব্যাগ বহন করার চেষ্টা করতেন। আর একারণেই অন্যান্য সমস্ত সঙ্গীতশিল্পীরাও তাঁকে খুব ভালবাসতেন। কারণ তিনি নিজে সকলকে শ্রদ্ধা করতেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।
জাকির হোসেনের অন্যতম ভালো দিক ছিল, তিনি চেষ্টা করতেন নতুনদের অর্থাৎ যুবাদের তুলে ধরার, তাঁদের সামনে নিয়ে আসার। বর্তমানে জাকিরের প্রচুর শিষ্য হয়েছে এবং তাঁরাও উঁচু স্তরের তবলাবাদক। এদের মধ্যে উজ্জ্বল অমিত কাভথেকর, আদিত্য কল্যাণপুর, যোগেশ সামসিরা উল্লেখযোগ্য।
জাকির হোসেনের স্মরণে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন উস্তাদ আমজাদ আলী খান;
জাকির হোসেনের সঙ্গে নিজের একসঙ্গে অনুষ্ঠানের স্মৃতিও জানালেন উস্তাদ। বললেন, তাঁরা যখনই একসঙ্গে বাজাতেন, স্মরণীয় হয়ে উঠত সেই কনসার্ট। শেষবার তাঁরা একসঙ্গে বাজিয়েছিলাম দিল্লিতে ২০২৩-এর ডিসেম্বরে। দুঃখ করে উস্তাদ বলেন, তখনও তিনি ভাবতে পারেন নি, জাকিরের সঙ্গে আর বাজানো হবে না। সঙ্গে তিনি যোগ করেন, এরপর লন্ডন থেকে আমেরিকায় তাঁদের যৌথ ভাবে বাজানোর পরিকল্পনা হয়ে ছিল।
জাকিরের স্মরণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন উস্তাদ আমজাদ আলী খান। বলেন, জাকিরের মতো ছন্দের বোধ বিরল। তাঁর ঠেকা ছিল মেট্রোনোমের মতো, নিখুঁত হিসাব এবং গাণিতিক মাপ তার। জাকির হোসেনকে ‘ক্যারিশমাটিক’ শিল্পী বলে আখ্যায়িত করলেন আমজাদ। বলেন, তিনি চলে যাওয়ায় বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল বিশ্ব এবং ভারতের তবলা জগতের, সঙ্গীত জগতের। এখন এটুকুই আশা, জাকির হোসেন এবং তাঁর বাবার পাঞ্জাব ঘরানা প্রবাহিত হবে ভবিষ্যতের দিকে এই বলে আমজাদ তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।