প্রতিটি মায়ের জন্যই তাঁর সন্তানের জন্ম এক অনন্য অধ্যাবসায়! সন্তান জন্ম দেবার দিন কষ্ট সহ্য করতে হয় প্রতিটি মাকেই। তবে অনেকের জন্য ভ্রূণ লাভ ও যেন এক তপস্যা। তেমনি এক গল্প আছে অভিনেত্রী সুদীপা চট্টোপাধ্যায়ের। সন্তান জন্মের জন্য তাঁকে কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, কত তপস্যা করতে হয়েছে তা জানান সুদীপা।
আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হয়েছেন সুদীপা
আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হয়েছেন সুদীপা। অসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে একরত্তিকে কোলে পেয়েছিলেন তিনি। সুদীপার কাছে এই প্রেগন্যান্সি জার্নিটা ছিল স্বপ্নের মতো। এক দশক আগেও টেলিভিশনের অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ ছিলেন সুদীপা চট্টোপাধ্যায়। তবে পুত্র আদিদেব আমন চট্টোপাধ্যায়কে কোলে পেতে তাঁর লড়াই অনেকেরই অজানা।
সুদীপা বলেন, প্রথম যে দিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আদির গাল তাঁর গালকে স্পর্শ করেছিল, সেই মুহূর্তে সম্পর্কের উষ্ণতা কী সেটা অনুভব করেছিলেন তিনি। ওই স্পর্শ কোনও দিন ভুলতে পারবেন না সুদীপা। আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হয়েছেন সুদীপা। যার ফলে গর্ভধারণ করতেও অনেকটা সময় লেগেছিল তাঁর। সেই সময় একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিদিন রান্নার শো সঞ্চালনা করতেন সুদীপা। একটানা দাঁড়িয়ে করতে হতো শুটিং। একদিনে ৬টা এপিসোডের শুটিং করতেন। সেই সময়ই ট্রিটমেন্ট চলছিল সুদীপার।
সুদীপা নিজের ব্যাপারে জানান, একটা সময় তিনি ইঞ্জেকশনের সূঁচ দেখে দশ হাত দূরে পালাতেন। সেখানে প্রতিদিন দুটো করে ইঞ্জেকশন নিজেকেই নিতে হতো। তাঁর কাজের স্টুডিয়ো এতটাই দূরে ছিল যে সেখানে কোনও নার্স আপ-ডাউন করতে চাইতেন না। মা হওয়ার পুরো জার্নিতে শুরু থেকে আদির জন্ম পর্যন্ত সুদীপা প্রায় ৩৯৪টি ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন।
সুদীপা আরও জানান, প্রেগন্যান্সির আগে তাঁর অনেক রকম সমস্যা দেখা দিয়েছিল। প্রেগন্যান্সি প্ল্যানিংয়ের সময় প্রায় বারো কেজি ওজন কমিয়েছিলেন তিনি। ছেলে আদিকে পেতে যে বেশ কষ্ট পোহাতে হয়েছে সেকথা বারবার উল্লেখ করেন তিনি। তাই তাঁর কাছে মা হওয়াটাই জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সুদীপা জানান, হেন কোনও মন্দির-মসজিদ-গির্জা নেই যার দ্বারস্থ তিনি হননি। যে যেখানের সন্ধান দিয়েছেন সেখানেই ছুটেছেন তিনি।
সন্তান জন্মের আগের ছোট্ট একটা ঘটনার মাধ্যমে নিজের যন্ত্রণার একটা মুহূর্ত তুলে ধরেন সুদীপা। বলেন, তিনি একবার সিনেমা হল গিয়েছিলেন। তিনি, তাঁর স্বামী অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায় আর অগ্নিদেবের বড় ছেলে আকাশ। তখন নাকি তাঁরা প্রায়ই সিনেমা দেখতে যেতেন। তখন সদ্যই আইভিএফ ট্রিটমেন্ট শুরু করেছেন তিনি। ট্রিটমেন্টে প্রথমবার অসফল হয়েছেন বলেও জানান তিনি। একসময় বাবা-ছেলে আইসক্রিম খেতে গিয়েছে বাইরে। হঠাৎ সুদীপা অনুভব করলেন, তাঁর কাঁধে একটা ছোট্ট হাত। পিছনের সিট থেকে একটা বাচ্চা তাঁকে উঁকি মেরে দেখছে।
সন্তান লাভের আগে সুদীপার মনের কষ্ট
সুদীপা বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন সে দিন। একজন গিয়ে অগ্নিদেবকে ডেকে এনেছিল। বলেছিল আপনার স্ত্রী হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তবে সুদীপা জানান আসলে তিনি কাঁদছিলেন তাঁর মনের যন্ত্রণায়।
সেই সময় ধারাবাহিকের স্ক্রিপ্ট লিখতেন সুদীপা। প্রতিদিন ছ’টা করে সিন লিখতে হতো। যেদিন আদি হবে বলে ভর্তি হয়েছেন, সেদিনও নাকি স্ক্রিপ্ট লিখে জমা দিয়েছিলেন তিনি। প্রথম দিকে তিনি দেখভালের জন্য জাপা আয়া রেখেছিলেন (যিনি বাচ্চা হওয়ার আগে থেকে মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। তারপর সবটা বুঝে নিয়ে বাচ্চা ও মায়ের দেখাশোনা করেন)। বিশাল খরচসাপেক্ষ এই আয়া সার্ভিস। মাসে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।
তবে এই জাপা আয়া রেখে বড্ড বিপদে পড়েছিলেন সুদীপা। হাসপাতালে সেই আয়া সারাক্ষণ ঘুমাতেন। সঙ্গে অভিনেত্রীকে পুরোপুরি ট্রমার মধ্যে রেখেছিলেন। নানা কুসংস্কারে ভরিয়ে রাখতেন, ব্ল্যাকমেল করতেন। একদিন গাড়ি নিয়ে কিছু কাজে বেরিয়েছিলেন সুদীপা। ফেরার পথে একটি ঘটনায় বদলে গেল তাঁর জীবনের প্রেক্ষাপট।
কীকরে বদলে গেলো সুদীপার জীবন?
সুদীপা বলেন, ‘বালিগঞ্জের মুখে দেখছি একটি চালার নীচে বসে এক ভদ্রমহিলা রান্না করছেন। তিনটে বাচ্চা তাঁর। জানলার কাচ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী রান্না করছো গো? বলল আলু ফুলকপির তরকারি, খাবে নাকি? জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাচ্চাগুলোকে কী ভাবে যত্ন করো গো? অমন সুন্দর হয়েছে। তখন হেসে বললেন ওরা তো ভাতের ফ্যান খায়।’
বাড়ি ফেরার পথে সে দিন তিনি নিজেকে বোঝালেন মা হিসাবে সকলেই চেষ্টা করেন নিজের সন্তানকে সেরাটা দেবার। তাই নিজেকে সবসময় নম্বর ওয়ান মা হবার দৌড়ে আর ছোটালেন না তিনি। ছেলে আদিকে খুব সাধারণ ভাবেই মানুষ করবেন বলে ঠিক করেন। সুদীপার কথায়, ‘সেই দিন থেকেই আমার জীবনটা বদলে যায় অনেকাংশে। নিজের হাতে সবটা করায় কনফিডেন্সও অনেক বেড়ে গিয়েছিল।’
সন্তানকে খুব সাধারণ ভাবে বড় করতে চান সুদীপা। নামজাদা স্কুল, ফার্স্ট হওয়ার কম্পিটিশন এসব থেকে অনেকটা দূরে রেখে মধ্যবিত্ত জীবনের মূল্যবোধটা শেখাতে চান তিনি। সুদীপার কথায়, তিনি বা অগ্নিদেব দু’জনেরই ছেলেকে নিয়ে একটাই স্বপ্ন, তাঁকে ভালো মানুষ হতে হবে। বাকি সবকিছু সময়ের সঙ্গে এমনিই হয়ে যাবে। কদিন আগেই পেরিয়েছে সুদীপা পুত্র আদিদেবের জন্মদিন। বেশি আড়ম্বরের সঙ্গে তা পালন করায় নেটিজেনদের কটাক্ষের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তবে সন্তান জন্মের দিনটা তো সব মায়েদের কাছেই ভীষণ স্পেশাল। সেটাকে একটু স্পেশাল ভাবেই পালন করা উচিত বলে মনে হয় সুদীপার।