একটা সময় ছিল যখন লোকে সিনেমা বা অভিনয়কে খুব একটা গুরুত্ব দিতো না। বর্তমান সময়ের মতো সিনেমার এতো রমরমা ছিলো না তখন। বরং এই পেশায় থাকা মানুষদের একটু বাঁকা চোখেই দেখতেন সাধারণ মানুষ। সেই সময় দাঁড়িয়ে ভারতীয় সিনেমায় এক অন্যতম মাইলফলক হয়ে দাঁড়ান অভিনেতা রাজ কপূর। এবছর অভিনেতার শতবার্ষিকীর জন্মদিন। জনপ্রিয় এক সংবাদমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে কি লিখলেন, চলচ্চিত্রবিদ্যার গবেষক ও অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়?
ইংরেজ সাম্রাজ্যের পতনের পর দেশভাগের ভয়াল থাবার সম্মুখীন হতে হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশকে। তবে প্রফেসর সঞ্জয়ের কথায়, এই সময়ের যত জনপ্রিয় নায়ক কিন্তু দেশভাগের উপহার স্বরূপ। রাজ কপূর এবং দিলীপ কুমার এসেছিলেন পেশোয়ার থেকে। অন্যদিকে অভিনেতা দেব আনন্দ আসেন পাঞ্জাব থেকে। তবে সংস্কৃতি চর্চার খুব বেশি চল সেসময় ছিল না। তারমাঝেই নিজের রূপ দিয়ে দর্শকমনকে ভুলিয়ে দেন রাজ।
সঞ্জয় বলেন, যে সময়ে রাজ ভারতীয় ছবিতে জায়গা করে নিয়েছিলেন তখন সবে ভারতে লুটতরাজ সেরে ব্রিটিশ নিজের দেশে পাড়ি দিয়েছে। দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্র। ওই সময়েই ধীরে ধীরে পর্দা থেকে বিদায় নিয়েছেন অশোক কুমার এবং বলরাজ সাহনি। তাঁর পিতা পৃথ্বীরাজ কপূরও ধীরে ধীরে নিজের পাঠ চুঁকিয়েছেন। সেই সময়ে নায়কের অবস্থানে জায়গা করে নেন রাজ কপূর। ভারতীয় সিনেমায় এক বিরাট পালাবদল ঘটল। প্রফেসরের ভাষায় রাজের মুখের সেই অসামান্য লাবণ্য, দর্শককে গাম্ভীর্য থেকে মুগ্ধতার দিকে টেনে নেয়। ফরাসি পণ্ডিত রলাঁ বার্ত হলিউডে এমন ‘মুখ’ সম্পর্কে নাকি মন্তব্য করেছেন, ‘‘অ্যাশিওরস দ্য প্যাসেজ ফ্রম অ টু চার্ম (যা শ্রদ্ধা থেকে আকর্ষণের জন্মকে সুনিশ্চিত করে)।’’
সাধারণ মানুষ যেভাবে মিল খুঁজে পেয়েছিল রাজ কপূরের গল্পের সঙ্গে!
রাজের কেরিয়ারের শুরুর সময়টায় সাধারণ মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসছেন জীবিকার খোঁজে। বিভিন্ন সিনেমার গল্পেও সেই গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উত্তমকুমারের ‘শাপমোচন’ সিনেমার গল্পেও সেরকমই দেখানো হয়। আর তাতেই সিনেমাও ব্যাপক হিট করে। গ্রাম থেকে শহরের আসার সেন্টিমেন্টই তখন মানুষকে টানছে। এই চাহিদাকে মাথায় রেখে কলকাতার মতোই তৎকালীন বম্বে শহরের সিনেমাতেও এক মনভোলানো গ্রাম তৈরি হচ্ছে। ফলে বাংলার উত্তম কুমারের মতোই বম্বের রাজ কপূরও কোথাও গিয়ে শহরের লোককথায় ‘অবিসংবাদিত সম্রাট’ হয়ে উঠলেন।
তাঁর সিনেমার গল্পে গ্রাম-শহরের ভেদাভেদ, নগরায়নের দোলাচল কিছুটা বাড়াবাড়ি ভাবেই দেখানো হয়েছে ঠিকই, তবে সেসময় এরকম অতিরিক্ত মেলোড্রামায় মাখা গল্পই লোকে বেশি পছন্দ করে বসেন। আর এই গল্পকথা সত্যি করে তুলতে এক আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন রাজ কপূর। সঞ্জয় লেখেন তাঁর সাফল্যের উৎস হচ্ছে এই মেলোড্রামার মুহূর্তটিকে একেবারে হিরের আংটির মতো ব্যবহার করা।
রাজ কপূরের পরিচয় নিয়ে বলাই যায়, তিনিই সরকারি সিলমোহর, সদ্য-স্বাধীন দেশে জাতিগঠনের স্মারক। রাজ কপূরকে দেখলে বোঝা যায়, এক দিকে যেমন বাস্তববাদ ভারতীয় ছায়াছবির জন্য একটি মানচিত্র তৈরিতে ব্যস্ত, তখন অতিনাটকীয়তার আদলে গ্রাম থেকে শহরে আসার অভিজ্ঞতা ও দেশের নানা বাঁধন নিয়ে সেলুলয়েডে তিনি পরীক্ষা করে চলেছেন। ‘আওয়ারা’, ‘বুট পলিশ’, ‘শ্রী চারশো বিশ’ উত্তর-স্বাধীনতার কালের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় জনজীবনের আধুনিকতার দোলাচলকে এঁকে দেয়।
বলিউড সিনেমার অন্যতম পরিচয় রাজ কপূর!
আজও ‘রাজ কপূর’ নামটা উচ্চারণ করলেই দর্শকের মনে পড়ে, ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি/ ইয়ে পাতলুন ইংলিশস্তানি/ সর পে লাল টোপি রুশি/ ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’ (ছবির নাম ‘ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’)। সঞ্জয় বলেন, “এই গানটি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে জাতীয় সঙ্গীতের বিকল্প হয়ে উঠেছিল। প্রায় যেন আমাদের বিদেশনীতি। একমাত্র উদারীকরণের পরেই আমরা এই গানটিকে ফেরালাম”। রাজ কপূরকে এই যুগের শাহরুখ খান বললেও কম হবে। অর্থাৎ, রাজ কপূরকে বাদ দিয়ে আধুনিক ভারতে জাতীয়তাবাদের ইতিহাস তৈরি হয় না।
প্রযোজক হিসেবে তিনি ‘মেরা নাম জোকার’, ‘ববি’ বা ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’র মতো সিনেমা প্রযোজনা করেন। সিনেমা জনসাধারণের স্বপ্নকেও প্রায় অনুবাদ করে দেয়। রাজ কপূরের সিনেমা সমাজের আশা-নিরাশা, দোলাচল, ব্যর্থতা ও সাফল্যকে এমন ভাবে বুনতে পারে, যে তা বারে বারে গ্রাম-শহরের মডেল হয়ে উঠতে পারে। যেমন ষাটের দশকে ‘সঙ্গম’ ছবিটি প্রেমের মধ্যে আরও নৈকট্যের বাসনা জুড়ে দেয়। ভারতীয় সিনেমার সেই মাইলফলককে জন্মশতবার্ষিকীতে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানান প্রফেসর সঞ্জয়।