মঞ্চের আলোয় যার ছায়া,
গল্পের ভাষায় যার কথা,
অসীম অভিনয়ের যাদু,
মনোজ মিত্র তাঁর নাম সার্থকতা।
মনোজ মিত্রের মৃত্যুতে বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্র জগত হারালো এক দিকপাল ব্যক্তিত্বকে, যাঁর নাট্যরচনার গভীরতা এবং অভিনয়ের স্বতন্ত্রতা তাঁকে আজীবন বিশেষ আসনে রেখেছে। মনোজ মিত্র কেবল একজন শক্তিশালী অভিনেতা ছিলেন না; তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, পরিচালক এবং নাটকের পরিপ্রেক্ষিতে এক নবজাগরণের নেতা। তিনি ১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর সাতক্ষীরায় (বর্তমান বাংলাদেশে) জন্মগ্রহণ করেন। দেশভাগের ফলে তাঁদের পরিবার কলকাতায় চলে আসে এবং এখানেই তাঁর শৈশব ও শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন।
প্রয়াত বর্ষীয়ান নাট্যকার ও অভিনেতা মনোজ মিত্র…
১৯৫৭ সালে তাঁর মঞ্চজীবনের সূচনা হয়, এবং তৎকালীন বাংলা থিয়েটার মঞ্চে মনোজ মিত্রের উত্থান অনেকটাই ছিল নাটকের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব। ১৯৫৯ সালে তিনি তাঁর প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ রচনা করেন। এই নাটকটি মঞ্চে প্রথাগত নাটকের ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সমসাময়িক সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের গভীর চিত্র তুলে ধরেছিল। এরপর তিনি একের পর এক সমাজকেন্দ্রিক নাটক রচনা করেন, যেমন ‘চাক ভাঙা মধু’, যা তাঁকে বাংলা নাট্যজগতে একজন স্বতন্ত্র স্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
মনোজ মিত্রের রচিত নাটকের মধ্যে অন্যতম ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, যা ছিল তাঁর নাট্য জীবনের এক অনন্য সাফল্য। এই নাটকটি এতই জনপ্রিয় হয় যে, পরে এটি চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়। এ নাটকটিতে তিনি জমি সংক্রান্ত বিষয়ের মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য ও গ্রামের মানুষের সংগ্রামের একটি চিত্র তুলে ধরেন। এটি কেবল যে মনোজ মিত্রকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল তা নয়, বাংলা নাট্য সাহিত্যকেও আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে ‘সাজানো বাগান’, ‘নাট্যকর পঞ্চাশ’ এবং ‘একটি স্বপ্নের দিন’। তিনি তাঁর নাটকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিচ্ছবি এবং মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বগুলো এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা দর্শকের মনোজগতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।
বাংলা নাট্যজগতের এক অমর কাহিনি…..
অভিনয়ের ক্ষেত্রেও মনোজ মিত্রের অসামান্য দক্ষতা ছিল। মঞ্চের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও তিনি তাঁর অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ‘আদালত ও একটি মেয়ে’, ‘ঘরে বাইরে’, এবং ‘শত্রু’ ছবিতে তাঁর অভিনয় আজও শ্রোতাদের মনে গভীর রেখাপাত করে। বিশেষ করে ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ছবিতে তাঁর চরিত্রটি ছিল সমাজের অন্ধকার দিক তুলে ধরা এক বিশেষ ভূমিকায়। মঞ্চের সাথে সাথে সিনেমায়ও তাঁর অভিনয়ের গভীরতা বাংলা চলচ্চিত্র জগতকে সমৃদ্ধ করেছে।
একজন নাট্যকার এবং অভিনেতা হিসেবে তাঁর অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ হয়েছে। তিনি সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নাট্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারসহ বহু সম্মান অর্জন করেন। তাঁর নাট্যরচনার মাধ্যমে তিনি সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধকে নতুন রূপ দিয়েছেন এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম ও সুখ-দুঃখকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে থিয়েটার হলো সমাজ পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম এবং তাঁর নাটকগুলির মাধ্যমে তিনি সেই চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
মঞ্চ ও পর্দার অনন্য শিল্পী মনোজ মিত্রের প্রয়াণে শোক……
মনোজ মিত্রের প্রয়াণে বাংলা সংস্কৃতি জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তাঁর নাটক ও অভিনয় আমাদের সমাজের মনোস্তত্ত্বের এক গভীর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিল। তাঁর অনন্য সৃষ্টিগুলি আজও মানুষের মননে বেঁচে আছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে।