উস্তাদ জাকির হুসেনের মৃত্যুতে সঙ্গীত জগত একটি বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। মাত্র ৭৩ বছর বয়সে, তিনি হৃদরোগজনিত সমস্যার কারণে ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সান ফ্রান্সিসকোর একটি হাসপাতালে দুই সপ্তাহ ধরে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে গোটা বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
জাকির হুসেন ছিলেন ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর তবলার মূর্ছনায় শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে যেত। ছোটবেলা থেকেই তাঁর প্রতিভা সবার নজর কেড়েছিল। মাত্র সাত বছর বয়সেই তিনি মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন। তাঁর বাবা, বিখ্যাত তবলা শিল্পী উস্তাদ আল্লারাখা, ছিলেন তাঁর প্রথম গুরু। বাবার সান্নিধ্য ও তাঁর কঠোর সাধনার ফলেই জাকির হুসেন তবলার জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন।
তাঁর সঙ্গীত জীবনের যাত্রা…
জাকির হুসেন শুধু একজন তবলা শিল্পী ছিলেন না; তিনি ছিলেন সঙ্গীতের এক অনন্য উদ্ভাবক। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাথে পাশ্চাত্যের জ্যাজ, রক, এবং ফিউশন সঙ্গীতের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে, তিনি বিখ্যাত ফিউশন ব্যান্ড ‘শক্তি’ গঠন করেন, যেখানে তিনি গিটারিস্ট জন ম্যাকলাফলিনের সঙ্গে মিলে নতুন ধরনের সুর সৃষ্টি করেছিলেন। এই ব্যান্ডের ‘Remember Shakti’ অ্যালবাম বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়।
বিশ্বব্যাপী খ্যাতি…
জাকির হুসেনের সঙ্গীত ভারত ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের মানুষের মন জয় করে। তিনি পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন, মিকি হার্ট, এবং আরও অনেক বিশ্বখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গীত ছিল আন্তর্জাতিকে সেতু রচনার এক অনন্য মাধ্যম। তিনি শুধু একজন পারফর্মার ছিলেন না, বরং চলচ্চিত্র ও থিয়েটারের জন্যও সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ‘Heat and Dust’ এবং ‘In Custody’ চলচ্চিত্রের জন্য তাঁর সঙ্গীত আজও স্মরণীয়।
তাঁর কাজের জন্য তিনি পেয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ এবং গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের মতো অসংখ্য পুরস্কার। উস্তাদ জাকির হুসেন কেবলমাত্র সঙ্গীতের জন্য পরিচিত ছিলেন না; তিনি তাঁর বিনয় এবং মানবিকতার জন্যও সবার কাছ থেকে শ্রদ্ধা আদায় করেছিলেন। তিনি নবীন সঙ্গীতশিল্পীদের সবসময় অনুপ্রেরণা দিতেন এবং সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতেন।
শেষ শ্রদ্ধা….
তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে সারা দেশ ও বিশ্ব থেকে শোকবার্তা আসছে। বলিউড তারকা রণবীর সিং থেকে শুরু করে সঙ্গীত জগতের মহীরুহরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। শংকর মহাদেবনের পুত্র শিভম মহাদেবন তাঁর স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, “আপনি সঙ্গীত। আপনার সুর, শিক্ষা, আর ভালোবাসা নিয়ে আমরা বড় হয়েছি। আপনাকে হারানোর শোক কখনো কাটিয়ে উঠতে পারব না।”
ভারতের রাজনীতিকরাও এই ক্ষতির কথা তুলে ধরেছেন। রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট বলেছেন, “তাঁর চলে যাওয়া ভারতীয় সঙ্গীতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।”
জাকির হুসেনের অবদান…
তাঁর সঙ্গীতের জাদু এবং সৃষ্টিশীলতা আমাদের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে। তবলা, যা এতদিন শুধুমাত্র শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অংশ হিসেবে বিবেচিত হত, তা তিনি বিশ্ব সঙ্গীতের মঞ্চে নিয়ে গেছেন। তাঁর হাত ধরেই তবলা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।উস্তাদ জাকির হুসেন আমাদের ছেড়ে গেলেও, তাঁর সুর ও তালের জগৎ আমাদের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে। সঙ্গীত জগতে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা আমাদের স্মরণে চিরকাল অমলিন থাকবে।