লোকগান এবং বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক অনেক পুরনো। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যগুলির মধ্যে অন্যতম কাব্য হলো মনসা মঙ্গল কাব্য। এই কাব্যের প্রধান গল্প বেহুলা-লখিন্দরের গল্প। যা গ্রাম বাংলার প্রত্যেকটি ঘরে আজও প্রাসঙ্গিক। এবার সেই গল্পকেই কার্যত এক ছকভাঙ্গা সুরে ‘মা লো মা’ গানটির মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বের সামনে নিয়ে এলো কোক স্টুডিও বাংলা।
বেহুলা-লখিন্দরের গল্প
কথিত আছে, শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন চাঁদ সওদাগর। তাই তিনি অন্য কোনও দেবতার আরাধনা করতেন না। অন্যদিকে শিবকন্যা মনসা কোথাও পূজিত হতেন না। পিতা শিবের বিধান অনুযায়ী যদি কোনও শিব উপাসক মনসার পুজো করেন তবেই মর্ত্যধামে তাঁর পুজো প্রচলিত হবে। তাই তাঁকে চাঁদ সওদাগরকে দিয়েই নিজের পূজোর প্রচলন করতে চেয়েছিলেন মনসাদেবী। কিন্তু শিবভক্ত মনসার এই প্রস্তাব অস্বীকার করেন। ক্রোধে মনসা তাঁর বংশ ধ্বংস করার পণ গ্রহণ করে। শিব কন্যা মনসার অভিশাপে এক এক করে সব সন্তানকে হারিয়ে ফেলেন চাঁদ সওদাগর। একমাত্র বেঁচে থাকেন লখিন্দর। লখিন্দরের সাথে বেহুলার বিয়ে দিয়েছিলেন চাঁদ সওদাগর। যথেষ্ট সতর্কার সাথে ছেলের বাসররাতের জন্য এক ঘর তৈরি করান তিনি। যাতে কোনও সাপ সেখানে প্রবেশ না করতে পারে। কিন্তু বিধির বিধান এতো সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও মৃত্যু হয়ে লখিন্দরের।
এর পর শুরু হয় বেহুলার যাত্রা।
স্বামীর নিথর দেহ ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পরেন বেহুলা। বহু জায়গায় ঘোরার পর অবশেষে সে পৌঁছায় দেবলোকে। নিজের প্রার্থনায় দেবতাদের সন্তুষ্ট করেন বেহুলা। চাঁদ সওদাগরকে তাঁর পুজো করতে হবে, এমনই শর্তে লখিন্দরকে প্রাণদান করতে রাজি হয়েছিলেন মনসা। মনসার শর্তে রাজি হয় বেহুলা। সে কথা দেয় শ্বশুরমশাইকে এই পুজো করার জন্য রাজি করাবে। সেকথাও রাখে বেহুলা। অবশেষে চাঁদ সওদাগর মনসার উপাসনায় রাজি হন। এই গল্প পরবর্তিকালে লোকগান হয়ে মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
গানে মঙ্গলকাব্য
অন্যদিকে, লোকসঙ্গীত ‘সারি গানের’ একটি ধারা ‘ছাদ পেটানোর গান’ শুরু হয় মোগল আমলে। এই গানটির একটি শহুরে সংস্করণ রয়েছে আশি ও নব্বই দশকের রাজমিস্ত্রীদের মধ্যে। জীবিকা নির্বাহের জন্য গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি দেওয়া এই শ্রমিকরা বাড়ির ছাদ তৈরি করার সময় এ ধরনের গান গাইতেন। ছাদ পেটানোর ছন্দের সঙ্গে গানের কথা মিলিয়ে একঘেয়েমি দূর করার পাশাপাশি কাজের সময় তৈরি হতো এক উৎসবমুখর পরিবেশ। ‘ছাদ পেটানো গানের’ সঙ্গে বেহুলা-লখিন্দরের গল্প সংযুক্তিকরণ দর্শকের কাছে এই গানের গভীরতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। জীবন যে একটি নিরন্তর যাত্রা এবং এ জীবনে অনিবার্যভাবে বড় কিংবা বুড়ো হওয়া যে একই মুদ্রার দুটো পিঠ। এমনটাই বোঝানো হয়েছে এই মা লো মা গানটির মধ্যে দিয়ে। এখানে ভাঙা নৌকার উপমা বলতে জীবনকে বোঝানো হয়েছে আর নদী বলতে বোঝানো হয়েছে পৃথিবীকে।
পুরনো গানকে নতুন ভাবে উপস্থাপনা করার জন্য প্রশংসা করেছেন অনেকেই। গানটি গেয়েছেন সাগর দেওয়ান, আরিফ দেওয়ান, আলি হাসান এবং প্রীতম হাসান। এই চারজনের পাশাপাশি গানটিতে অংশ নিয়েছেন আরও একঝাঁক শিল্পীরা। এই “মা লো মা” গানটি নিয়ে নানা তর্ক বিতর্ক থাকলেও ইউটিউবের গ্লোবাল টপ মিউজিক ভিডিওর তালিকায় এখনও ট্রেন্ডিং এই ‘মা লো মা’ গানটি।