জনপ্রিয় এক সংবাদমাধ্যম আয়োজিত ‘বছরের বেস্ট ২০২৪’ শুরু হল উপনিষদের স্তোত্রে। নাহ, কোনো উদ্বোধনী সংগীত নয়, বছরের শেষ লগ্নে, পুরোনো বছরকে বিদায় জানানোর লগ্নে সেই বছরের সেরাদের বেছে নেওয়ার উৎসবে মাতোয়ারা ছিলো সকলে। সেই অনুষ্ঠান শুরু হলো স্তোত্র পাঠের মধ্য দিয়ে। মন শান্ত করা সেই মন্ত্রে সুর দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘যদি ঝড়ের মেঘের মতো আমি ধাই চঞ্চল–অন্তর/ তবে দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে, দয়া কোরো ঈশ্বর’।
রবিঠাকুর যেন সাধারণ মানুষের মনের কথা বুঝতেন। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিতেই তাই যা বলেছেন বা লিখেছেন সেকথা গুলোকে আপন করে নিতে পারে সকলে। তবে এই উপনিষদের লাইনগুলো রবিঠাকুর সৃষ্ট নয়। তবে উপনিষদে বলা এ প্রার্থনা যেন আমাদের সকলের মনের। সেই অপার পুরুষের কাছে আমাদের প্রার্থনা যেন শুধু আমাদের জীবনে তাঁর দয়া।
আধুনিক প্রজন্মের গায়কের গলায় অনুষ্ঠানের সূচনা উপনিষদের মন্ত্রে!
তবে অনুষ্ঠানের সূচনা কোনো স্নিগ্ধ উদ্বোধনী সংগীতেও তো হতে পারত। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে উপনিষদের স্তোত্রগানে মশগুল হলো পুরস্কার বিতরণী সন্ধ্যা। এযেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক অপার মেলবন্ধন। তবে কেন উপনিষদের এই গানের সঙ্গেই অনুষ্ঠানের সূচনা হলো? প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা পাওলি দাম। উত্তর এলো অভীক সরকারের বক্তব্যে।
উপনিষদে বলা ঈশ্বরের উদ্দ্যেশ্যে বলা প্রার্থনা, সুরে মাখিয়ে গাইলেন এই প্রজন্মের অন্যতম গায়ক অনুপম রায়। তবে উদ্বোধনী সংগীত এর জায়গায় এই মন্ত্র পাঠের কারণ হিসেবে অভিক সরকার জানান, উপনিষদের ওই সুরই নাকি অনুরণন তুলবে পরবর্তী অনুষ্ঠান জুড়ে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বক্তব্য রেখেছিলেন অভীক সরকার, নিজের বক্তব্যে সে কথাই বুঝিয়ে বললেন তিনি।
অনুপম নিজে একজন গায়কের পাশাপাশি সংগীত পরিচালক। তাঁর লেখা গানের শব্দ নতুন প্রজন্মকে জীবনের ভাষা খুঁজে পেতে সাহায্য করে। একটা প্রজন্ম, যাঁদের কাছে জীবনের মানে গভীরে যাওয়ার টান, তাঁরা নিজেদের জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে অনুপমের গানের শব্দে। তবে সোমবার সন্ধ্যেয় একেবারে আলাদা রূপে ধরা দিলেন অনুপম। বছরের সেরাদের বেছে নেওয়ার অনুষ্ঠানে তাঁর এই গান এক অন্য মহল তৈরি করল।
খাঁটি বাঙালির রূপে ধরা দিলেন গায়ক অনুপম রায়!
এদিন অনুপম সেজেছিলেন বেশ বাঙালি সাবেকি সাজে। তাঁর পরনে ছিল সুতোর কাজ করা গাঢ় লাল রঙের পাঞ্জাবি-ধুতি। তার সঙ্গে সুতোর কাজ করা ঘি রঙা শাল। এমনিতে কিন্তু তাঁকে দেখা যায় হাল ফ্যাশনের পোশাকে। কিন্তু ‘বছরের বেস্ট ২০২৪’-এর মঞ্চে তাঁর কণ্ঠে উপনিষদের গান ও পরনে সাবেকি পোশাক অন্য মাত্রা জুড়ল।
অনুষ্ঠানের সূচনা কেন উপনিষদের এই গানে হলো, সঞ্চালিকা পাওলি দাম এই প্রশ্ন করতেই, উত্তর আসলো অভীকবাবুর বক্তব্যে। ‘বছরের বেস্ট’-এর চতুর্থ বছর এটি। প্রথম তিন বছরে রয়েছে বাঁধ ভাঙা বাঙালিদের কথা। তবে এই চতুর্থ বছরে রয়েছে কিছু পরিবর্তন। ঐতিহ্য এবং পরিবর্তনের দ্বন্দ্বকে স্বাগত, ভবিষ্যতের জন্য সাহসী পদক্ষেপকেও, বললেন অভীক সরকার।
এ দিন অনুষ্ঠানের শুরুতেই তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছুঁয়ে গিয়েছে আরজি করের ভয়ঙ্কর ঘটনাকে। তাই এসেছে পরিবর্তনের প্রসঙ্গ। তিনি বলেছেন, “প্রধান পরিবর্তন, মিছিল-আন্দোলন আবার আমাদের জীবনে ফেরত এসেছে। মাঝখানে কিছু মিছিল-ধর্মঘট নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু সিঙ্গুর এবং ন্যানো নিয়ে আন্দোলনের পরে এই ধরনের আন্দোলন হয়নি। সেটা ফিরে এসেছে। আরজি কর হাসপাতালের ঘটনায় এর প্রকাশ হয়েছে স্ফুলিঙ্গের মতো।’’
তবে আন্দোলনের সঙ্গেই রয়েছে ধারাবাহিকতাও। বাঙালির ব্যবসা বিমুখতার ধারাবাহিকতার কথা বলেছেন তিনি। উপনিষদের গানেও ধারাবাহিকতা ও আসন্ন পরিবর্তনের দ্বন্দ্বের কথা উঠে এসেছে। অতীতের দিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে থাকা নয়, অভীকবাবুর দর্শনে রয়েছে ঐতিহ্য এবং পরিবর্তনের মধ্যেকার ‘বিরোধাভাস’, যা ভবিষ্যতের দিকে তাকায়। তাই তাঁর বক্তব্যের ঠিক আগেই অনুপমের কণ্ঠে উপনিষদের গান দিয়েই শুরু হল এই সন্ধ্যার সূচনা। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই অনুষ্ঠান।