গত বৃহস্পতিবার বিকেলে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সবুজ চত্বরে বিশেষ এক নাচের অনুষ্ঠানে মুগ্ধ হলেন দর্শকরা। হুইলচেয়ারে বসে একাধিক মনোমুগ্ধকর নৃত্য পরিবেশনা করলেন ‘নব উত্থান’ গ্রুপের বিশেষভাবে সক্ষম শিল্পীরা। তাঁদের নাচ, যোগব্যায়াম, ভারতনাট্যম ও মার্শাল আর্টের পারফরম্যান্স সবার মন জয় করে নেয়।
‘নব উত্থান’-এর যাত্রা
‘নব উত্থান’ গ্রুপের শুরু ২০০৮ সালে। গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও কোরিওগ্রাফার চেতন উপাধ্যায় জানালেন, “আমরা সবাই একসঙ্গে পড়তাম। সেখান থেকেই এই পথচলা শুরু। ২০১৩ সাল থেকে আমরা বিভিন্ন জায়গায় পারফর্ম করা শুরু করি। শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও আমাদের পারফরম্যান্সের সুযোগ হয়েছে।” তাঁদের কাজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ২০১০ সালের কমনওয়েলথ গেমসের ক্লোজিং সেরেমনিতে অংশগ্রহণ। এছাড়াও তাঁরা রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নিজেদের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে তাঁরা বারবার প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছা থাকলে সবকিছু সম্ভব।
অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স
অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল তাঁদের ডান্স পারফরম্যান্স, যেখানে তাঁরা হুইলচেয়ার ব্যবহার করেই সুনিপুণ ভঙ্গিমায় নৃত্য পরিবেশন করেন। তাঁদের মধ্যে কেউ পোলিওতে আক্রান্ত, আবার কেউ ট্রেন দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছেন। কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতা তাঁদের থামাতে পারেনি।
অনুষ্ঠানে তাঁরা ভারতনাট্যম, মার্শাল আর্ট ও যোগব্যায়ামের মতো চ্যালেঞ্জিং পরিবেশনা দেখিয়েছেন।চেতন উপাধ্যায় আরও বলেন, “অনেক সময় পারফরম্যান্সের আগে অনেকে আমাদের নিয়ে চিন্তিত থাকেন। কিন্তু যখন অনুষ্ঠান শেষে সবাই এসে প্রশংসা করেন, তখন খুব ভালো লাগে। এটি আমাদের আরও ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয়।
“‘আমি আর্টস ফেস্টিভ্যাল’-এর অংশগ্রহণএই বিশেষ পারফরম্যান্স ছিল ‘আমি আর্টস ফেস্টিভ্যাল’-এর একটি অংশ। ফেস্টিভ্যালটি আয়োজন করেছে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)। কেসিসি-র চেয়ারপার্সন রিচা আগারওয়াল বলেন, “এই প্রতিভাবান শিল্পীদের মঞ্চ দিতে পেরে আমরা গর্বিত। তাঁদের নাচ দেখে আমরা অভিভূত।”ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সেক্রেটারি ও কিউরেটর সমরেন্দ্র কুমার জানালেন, “এই অনুষ্ঠানে দর্শকদের ভিড় আমাদের অবাক করেছে। ভবিষ্যতে এমন আরও অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে রয়েছে।”
স্বপ্নপূরণের গল্প
‘নব উত্থান’ গ্রুপের প্রতিটি সদস্যের জীবনেই একেকটি লড়াইয়ের গল্প লুকিয়ে আছে। তাঁদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হয়তো অনেক বড় বাধা হতে পারত, কিন্তু নিজেদের প্রতিভা, কঠোর পরিশ্রম এবং ইচ্ছাশক্তির জোরে তাঁরা সব বাধা অতিক্রম করেছেন। এই পারফরম্যান্স ছিল সেই জেদ আর স্বপ্নপূরণের গল্প তুলে ধরার এক নিখুঁত উদাহরণ।
প্রেরণার বার্তা
এই বিশেষ পারফরম্যান্স শুধুমাত্র বিনোদন নয়, এটি একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে—শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কখনও মানুষের স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হতে পারে না। চেতন উপাধ্যায় এবং তাঁর দলের সদস্যরা যেভাবে নিজেদের প্রতিভা এবং দক্ষতা দিয়ে মঞ্চ কাঁপালেন, তা নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সবুজ চত্বরে ওই দিন উপস্থিত থাকা প্রত্যেক দর্শকই যেন তাঁদের মনোভাব নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন—স্বপ্ন পূরণে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কোনওদিনও বাধা হতে পারে না।