অরিত্র দত্ত বণিক, একদা বাংলার ছোটপর্দা ও সিনেমার জনপ্রিয় শিশুশিল্পী, আজকে বড় হয়েছেন এক সফল অভিনেতা ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। শিশুশিল্পী হিসেবে তাঁর কেরিয়ার শুরু হয়েছিল খুবই কম বয়সে, ৩-৪ বছর বয়সে আবৃত্তি শুরু করেন মঞ্চে, যার ফলে নজর কাড়েন টেলিভিশন পরিচালক যিশু দাশগুপ্তের। তাঁর প্রতিভা দেখে, তাকে টেলিভিশনের জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘তিথির অতিথি’তে কাস্ট করা হয়। তারপর, সিনেমার জগতে প্রবেশ করেন, যেখানে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
অরিত্র দত্ত বণিকের প্রথম সিনেমা ছিল ‘ক্রান্তি’, যা পরিচালনা করেছিলেন অর্ণব রিঙ্গো বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর একের পর এক জনপ্রিয় বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন, যেমন ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’, ‘পরাণ যায় জ্বলিয়া রে’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘হাঁদা ভোঁদা’, ‘ওয়ান্টেড’, ‘লে ছক্কা’, ‘কানামাছি’, ‘লে হালুয়া লে’ এবং ‘লাভেরিয়া’। সেই সময় দেব, মিঠুন চক্রবর্তী সহ বেশ কয়েকজন বড় তারকা তার প্রতি বিশেষ স্নেহ প্রদর্শন করতেন। এমনকি, দেবের প্রথম দিকের ছবিগুলিতেও অরিত্রর উপস্থিতি ছিল, যা তার কেরিয়ারে এক বিশেষ জায়গা তৈরি করে।
অরিত্র দত্ত বণিকের সঙ্গে তার বন্ধুত্ত্ব সম্পর্কের মধ্যে অন্যতম ছিল দেবের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব। ছোটবেলায়, তিনি দেবের মেকআপ ভ্যানে পড়েই থাকতেন, আর একসঙ্গে এক্সারসাইজও করতেন। তাঁর মতে, তখন তাঁর ধারণা ছিল না যে, দেব কত বড় একজন তারকা, তিনি যে তখন এতটাই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তা সে বুঝত না। তাঁর দৃষ্টিতে, দেব ছিলেন একজন বড় ভাই। যদিও বর্তমানে তাঁর দেবের সঙ্গে যোগাযোগ কমেছে, তবে দেবের জন্মদিনে তাঁরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকেন এবং দেবের শারীরিক অসুস্থতার সময় তিনি তার খোঁজ নিয়েছিলেন।
দেবের প্রযোজিত ছবিতে ডাক না পাওয়ার আক্ষেপ…
একটি বড় আক্ষেপ হিসেবে, অরিত্র উল্লেখ করেন যে, দেব কখনও তাকে তাঁর প্রযোজিত ছবিগুলির জন্য ডাকেননি। তবে, সে এ নিয়ে কোনও তেমন আক্ষেপ অনুভব করেন না। অরিত্র বলেন, “যদিও আমি প্রোডিউসার দেবের কাছে কখনো কোনও ছবি করার জন্য ডাক পাইনি, কিন্তু যদি তিনি ডাকতেন, আমি অবশ্যই যাব।” অর্থাৎ, সে সময়ই তিনি আরও কাজ করতে চাইতেন যদি সুযোগ পেতেন।
অরিত্র দত্ত বণিকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, পরিচালনা না প্রযোজনা?
অরিত্র বাংলার চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির পরিবর্তনও চোখের সামনে দেখেছেন। তিনি মনে করেন, চলচ্চিত্রের নির্মাণ প্রক্রিয়া অনেকটাই বদলে গেছে। এক সময় যেখানে একটি সিনেমা তৈরির জন্য মাসের পর মাস সময় দেওয়া হতো, সেখানে এখন তা সম্পন্ন হচ্ছে মাত্র ১০-১২ দিনের মধ্যে। আগের দিনে, যেমন ‘পরাণ যায় জ্বলিয়া রে’ কিংবা ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’-এর মতো ছবির শুটিং মাসখানেক ধরে চলত, সেটাই ছিল নিয়ম। অথচ, এখন সময়ের এতটাই অভাব যে, চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে একে অপরকে বুঝে নেওয়ার সময় পাওয়া যায় না। অভিনেতাদের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ও কমে গিয়েছে।
শিশুশিল্পী হিসেবে অরিত্র দত্ত বণিকের অভিজ্ঞতা…
অরিত্র বলেন, “এখনকার ছবিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ডেলিভারি বা দ্রুত কাজ শেষ করার দিকে। কিন্তু এটি শুধু সিনেমার বাজেটের কারণে হচ্ছে না, বরং একে কর্পোরেট পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরো টিম একে অপরের সঙ্গে একাত্ম হতে পারছে না, যেহেতু কাজ দ্রুত শেষ করার চাপ রয়েছে। এর ফলে অনেক সময় শিল্পের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এবং পরিচালকরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজের সৃজনশীলতা হারাচ্ছেন।”
এই সমস্ত পরিবর্তন দেখতে দেখতে, অরিত্র বাংলার সিনেমা নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে প্রযোজনার ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ বাড়েছে, কারণ তিনি মনে করেন, ছোটবেলায় যেভাবে ক্যামেরার সামনে কাজ করতে গিয়ে তার মধ্যে এক অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল, সেভাবেই তিনি এখন প্রযোজনায় যুক্ত হতে চান। তাঁর মতে, শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করার সময় বারবার মনে হতো, “যা কিছু আমি করছি, তা কালো টেপে রেকর্ড হয়ে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিন্তু সেই কাজটার সঙ্গে আরও কী কিছু হচ্ছে, তা জানি না।” সেই আগ্রহ থেকেই আজকাল তিনি প্রযোজনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং ভবিষ্যতে এই ক্ষেত্রে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
অরিত্র দত্ত বণিকের এই অভিজ্ঞতা এবং তাঁর চিন্তাভাবনা বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির একটি বড় পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরে। তার পথচলা, তাঁর স্নেহশীল সম্পর্ক এবং বর্তমানে চলচ্চিত্রের যে পদ্ধতির পরিবর্তন দেখছেন, তা ইন্ডাস্ট্রির গতিপথকেও অন্তর্নিহিতভাবে প্রভাবিত করেছে।